Friday 2 March 2007

ডারউইনবাদ এবং ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন

জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই মানুষকে যে জিনিষটি সবচেয়ে বেশী তাড়িয়ে ফেরে তা হলো দুনিয়ায় তার অস্তিত ্ব কি করে হলো। বুদ্ধিবৃত্তির শৈশব কালে তাকে এ প্রে শরড়ব জবাব জুগিয়েছে বাইবেল। ১৯ বিংশ শতক পর্যন্ত পশ্চিমা দুনিয়ায় সেটাই সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে গ্রহনীয় মত ছিল। আর বাইবেল আমাদের বলে: ১. দুনিয়ার সূচনা হয়েছে মাত্র ৫৭৫৭ বছর আগে। ২. দুনিয়াতে কোন পরিবর্তন হচ্ছেনা। ৩. সৃষ্টি জগতের সমস্ত প্রাণীই তাদের বর্তমান আকার আকৃতিতে তৈরী হয়েছে এবং কোন রকম কোন পরিবর্তন তাদের হচ্ছেনা, বা হয়নি। ৪. একটা সুবিন্যস্ত এবং সুশৃংখল জগৎ কেবলমাত্র একজন সৃষ্টিকর্তার পক্ষেই তৈরী এবং রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব। ৫. সৃষ্টি জগতের অন্যান্য প্রাণীকুলের চাইতে মানুষের সৃষ্টি তাৎপর্যপূর্ণ। ১৮৫৯ সাল পর্যন্ত এটাই ছিল জীবন ও সৃষ্টি সম্পর্কে মানুষের ধারণা। তারপর বিবর্তনবাদ এসে মানুষের এই প্রচলিত ধারণাকে তছনছ করে দেয়। চার্লস ডারউইন নামে একজন বৃটিশ শৌখিন প্রকৃতিবিৎ তার ঙৎরমরহ ড়ভ ঝঢ়বপরবং গ্রন ্থ প্রকাশ করেন। এতে তিনি নতুন এক তত্ত্ব দেন পৃথিবীতে প্রাণের উন্মেষ আর বিকাশ সম্পকের্। তার তত্তের্ব দুটো গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো: ১. দুনিয়াতে বিবর্তন সংঘটিত হচ্ছে ২. আর এই বিবর্তন পরিচালিত হচ্ছে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে। বিবর্তনবাদে এই দুটো নিয়ামক সম্পর্কে তিনি কিভাবে সিদ্ধান্তে পৌছলেন? ব্যাপারটা বেশ কৌতুহল উদ্দীপক। ১৮৩৫ সাল থেকে ১৮৩৬ সাল পর্যন্ত ডারইউন দক্ষিণ আটলান্টিক এবং প্রশান্ত মহাসাগর ভ্রমণ করেন। এই ভ্রমণ তাকে স্থল আর জলের বিভিন্ন প্রাণী পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ এনে দেয়। একটা নির্দিষ্ট ভৌগলিক অঞ্চলে একই প্রজাতির মধ্যে বিভিন্ন বৈচিত্র অবলোকন করে তিনি বেশ হতবাক হন। এটা তাকে ভাবতে বাধ্য করে যে প্রজাতি সমূহ আসলে একটা আরেকটা থেকে উদ্ভব হয়েছে। তারপর তিনি লক্ষ্য করেন মানুষেরা বিভিন্ন প্রাণী সংকর প্রজনন করছে উন্নত প্রাণী তৈরীর আশায়। তিনি সিদ্ধান্তে পৌছেন মানুষের নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে নির্বাচনের কাজটি মানষু ই করে। কিন্তু প্রকৃতির জগতে এই নির্বাচনের কাজটি করছে কে? ১৮৩৮ সালে ডারউইন ম্যালথাসের দেয়া জনসংখ্যা সংক্রান্ত তত্ত্ব দ্বারা বেশ প্রভাবিত হোন। ম্যালথাস তার তত্ত্বে বলেন 'যারা উৎপাদন করে কেবল তাদেরই টিকে থাকার অধিকার আছে, আর যারা অন্যের উৎপাদনে বেঁচে থাকে তাদের প্রতি সকল সহযোগিতার দ্বার সংকুচিত করতে হবে।' এই তত্ত্ব ডারইউনকে 'যোগ্যতমের উদ্বর্তন' ধারণা নিতে সহযোগিতা করে। ডারইউনের বিবর্তনবাদ মানুষকে প্রচণ্ড নাড়া দেয়। এতকাল তারা বিশ্বাস করে এসেছে সৃষ্টি তত্ত্বের ওপর। আর্নেষ্ট হেকল এবং টি. এইচ হাক্সলি ডারইউনের এই তত্ত্ব সমর্থন করেন। তারা এই সাথে এও যোগ করেন যে, মানুষ বানর জাতীয় কোন প্রাণী থেকে উদ্ভব হয়ে থাকবে। মানুষকে এভাবে তারা জন্তুকুলের সমগোত্র ভক্তু করে দেন। বাইবেলের সৃষ্টি সংক্রান্ত মতের এখানেই মৃত্যু ঘটে এবং ইংল্যান্ডে নাস্তিকতার বিকাশ ঘটে। এর আগেই জার্মানী এবং ফ্রান্স ধর্মকে প্রত্যাখান করেছিল। পরবর্তীকালে কার্লমার্কসও তার সমাজবাদী মতাদর্শ পরিচিত করতে ডারউইনবাদের সাহায্য নেয়। লেনিন ডারউইনের সম্মানে বিজ্ঞান যাদুঘর স্থাপন করেন। জনগণের মন থেকে খ্রীষ্ট ধর্মের ধারণা পুরোপুরি দূর করাই তার উদ্দেশ্য ছিল। পরবর্তীতে, জীবাশ্মবিদ, অনুজীববিদ এবং জীনতত্ত্ববিদদের কাজ থেকে আমরা জানতে পারি যে, প্রাণীদের বিদ্যমান দৈহিক এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বংশগতির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। কৌষিক পর্যায়ে প্রতিটি শরীরবৃত্তিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রন করে জীন। জীনের প্রাণরাসায়নিক উপাদান হলো ডি, এন, এ, বা ডি অক্সো রাইবো নিউক্লিয়িক এসিড। কোষের নিউক্লিয়াসে তার অবস্থান এবং আর, এন, এ'র মাধ্যমে প্রোটিন তৈরীর রন্ধন শালায় সে সংবাদ আদান প্রদান করে। শত শত প্রাণরাসায়নিক বিক্রিয়া সাইটোপ্লাজমে প্রতি নিয়ত সংঘটিত হচ্ছে। শত শত এনজাইম বা প্রাণরস সেসব বিক্রিয়া ঘটাতে অংশ নিচ্ছে। আর এই মহা লংকা কাণ্ডের চমৎপ্রদ দিকটি হচ্ছে, এতসব বিক্রিয়ার কোনটাই একটা আরেকটার সাথে ধাক্কা খায়না। সব কিছুই ডি, এন, এ'র প্রখর তত্তাবধানে। ডি, এন, এ কোষের অভ্যন্তরে সূষম নিয়ন্ত্রন বজায় রেখেছে। কিন্তু এই ডি, এন, এ কেবল ৪টা এমাইনো এসিডের সমাহার, যা কিনা চমৎকার পর্যাবর্তনে সন্নিবেশিত। বছরের পর বছর থেকে বিজ্ঞানীরা অবাক হাতড়ে ফিরছে এই ৪ টি এমাইনো এসিড এলো কোত্থেকে? এই প্রশ্নের জবাব দেয়ার জন্য ১৯৫৫ সালে ডঃ মিলার তার গবেষণাগারে একটা পরিক্ষা চালান। তিনি মিথেন, হাইড্রোজেন, এমোনিয়া, বাষ্প এবং পানির এক সংশ্লেষণ তৈরী করেন। এই সংশ্লেষণের মধ্য দিয়ে তিনি তড়িৎ প্রবাহ চালান। এভাবে তিনি পানিতে এমাইনো এসিড তৈরী হওয়ার সম্ভাবনা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, পৃথিবীর আদিম বাতাবরণে এই সব গ্যাসের উপস্থিতি ছিল। প্রতিবেশিক এইসব গ্যাস বজ্রবিদ্যুত দ্বারা তড়িতাহত হয়ে প্রথম এমাইনো এসিডের তৈরী করে। এরপর তা দৈবক্রমে পর্যায়ক্রমিক সন্নিবেশনের মাধ্যমে ডি, এন, এ তৈরী করে এবং প্রথম জীন কোড তৈরী হয়। প্রাণের সূচনা হয় এককোষী প্রাণীর মাধ্যমে। কোটি কোটি বছরের ধারাবাহিকতায়, এককোষী জীব বহু কোষী জীবে পরিণত হয়। প্রথমে উদ্ভিদ জগৎ, তারপর প্রাণীজগৎ অমেরুদন্ডী থেকে মেরুদন্ডীতে রূপান্তরিত হয়। পর্যায়ক্রমে আসে, পোকা-মাকড়, মাছ, সরীসৃপ, পাখি, স্তন্যপায়ী এবং সবশেষে মানুষ। তবে বিবর্তনবাদের মাঝে মারাত্মক অসংগতি আছে। প্রথম হলো কেউই নিশ্চিত করে জানেনা পৃথিবীর আদিম বাতাবরণে আসলেই ঐসব গ্যাসের উপস্থিতি ছিল কিনা। দ্বিতীয়তঃ কিভাবে কেবল দৈবক্রমে এত জটিল কিন্তু সুষম প্রাণকোষের উদ্ভব হলো? না এটা হওয়া মোটেই সম্ভব নয়। ফরাসী বিজ্ঞানী ডঃ মরিস বুকাই'এর মতেঃ 'এটা বলা খুবই অযৌক্তিক যে, লোহা আর কয়লা মিলে অতি উচ্চ তাপ মাত্রায় ইস্পাত তৈরী হয়ে সয়ংক্রিয়ভাবে আইফেল টাওয়ারের উদ্ভব ঘটিয়েছে।' উপরন্তু আজ পর্যন্ত কেউই এটা দেখাতে পারেনি যে, এক প্রজাতি রূপান্তরিত হয়ে আরেক প্রজাতিতে পরিণত হয়েছে। কি এমন প্রমাণ আছে যে, মানুষ বৃহদ বানর থেকে এসেছে? এটা পুরোপুরিই প্রাণীদের শারীরিক এবং কংকালতান্ত্রিক মিল থেকে তত্ত্বায়ন করা হয়েছে। বলা যায় এটা মানুষকে পশুর পর্যায়ে এবং পশুকে মানবিক পর্যায়ে নিয়ে আসার একটা প্রয়াশ। বিবর্তনবাদের ধারাবাহিতকতার দিকে লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে প্রথমে এসেছে উদ্ভিদকুল। কেন? কারণ প্রাণীদের বেচে থাকার জন্য প্রয়োজন অক্সিজেন। আর উদ্ভিদ অক্সিজেন তৈরী করে। সুতরাং সৃষ্টিকর্তা প্রাণীকুল তৈরীর আগে তাদের বেচে থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন, তারপর তাদের দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন।
মানুষের রূপান্তর বিজ্ঞানের মতে মানবজাতি ৪ টি বিবর্তনিক পর্যায় অতিক্রম করেছে। এগুলো হলোঃ অস্ট্রালোপেথিকাসঃ মানবাকৃতির প্রাণীদের মধ্যে এরা হলো সবচেয়ে প্রাচীন। ১.৫ মিটার লম্বা এই মানুষেরা আধুনিক গড়পড়তা মানুষদের চাইতে খর্বাকায় ছিল। মস্তিস্কের ধারণ ক্ষমতা ছিল ৫০০ ঘন সি সি। এদের চিন্তা এবং যন্ত্রপাতি ব্যবহার করার ক্ষমতা ছিল। ৩৫ লক্ষ বছর আগে এরা পৃথিবীতে বসবাস করতো। পরে অপর মানবাকৃতির প্রজাতি পিথাকানথ্রোপাইসরা এদের স্থলাভিষিক্ত হয়। মানবাকৃতি প্রজাতির এরা ছিল দ্বিতীয় দল। ধারণা করা হয় ৫ লক্ষ বছর আগে এরা পৃথিবীতে বিচরণ করতো। এই পর্যায়ে মানুষের মস্তিস্কের ধারণ ক্ষমতা বেড়ে হয় ৯০০ ঘন সি সি। এরা লম্বায় ছিল ১.৫৮ সেন্টি মিটার থেকে ১.৭৮ সেন্টি মিটার পর্যন্ত। বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতাও বেশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। এদের চিন্তা এবং উদ্ভাবনেরও ক্ষমতা ছিল। ১ লক্ষ থেকে ৬০,০০০ বছর আগে নিয়ান্ডারথালরা এদের প্রতিস্থাপিত করে। এরা ছিল মধ্যম গড়নের এবং পুরোপুরি দ্বি-পদী প্রাণী। নিচু কপাল, সরু চিবুক এবং মস্তিস্কের ধারণ ক্ষমতা ছিল ১৩০০ সি সি। তারা নিজেদের মৃতদের কবরস্থ করতে জানতো। এরা গুহায় বাস করতো। তাদের মধ্যে আধ্যাতিকতারও কতটা চল ছিল। হোমো সেপিয়েন্সঃ আজ থেকে ৪০ হাজার বছর আগে আধুনিক মানুষের উদ্ভব। গড় উচ্চতা বেড়ে হয় ১.৭৮ সে.মিটার আর মস্তিস্কের ধারণ ক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় ১৩৫০ সি সি তে। মাথার আকৃতি গোলাকার হয়। মুখের ঠেলে বের হওয়া অংশ দূর হয়। এবং মানষিক ক্ষমতা পূর্বসূরীদের থেকে অনেক বৃদ্ধি পায়। এ হলো মানব বিবর্তনের চার পর্যায়। যেখানে এক দল আরেক দল দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে। প্রতিটি উত্তরসূরী দলই তাদের পূর্বসূরীদের চাইতে উন্নত ছিল মেধা, মনন এবং শারীরিক বিচারে। ৪০ হাজার বছর আগে মানুষের মস্তিস্কের যে ধারণ ক্ষমতা ছিল আজো তাই আছে, যদিও মানুষ তখন আদিম ছিল এবং মস্তিস্কের এতো ধারণ ক্ষমতার কোন প্রয়োজনই ছিলনা। কেন? রবার্ট অরনস্টেইন তার গ্রন্থ Evolution of Conscience এ প্রশ্নটাই করেছেন. এর পেছেনে অবশ্যই কতক উদ্দেশ্য আছে। অহেতুক কোন কারণে তা করা হয়নি। কেন আমাদের খুবই উন্নত দর্শন ইন্দ্রিয় আছে। কেন সৃষ্টিকর্তা আমাদের সুক্ষ শ্রবণ ক্ষমতা দিয়েছেন? প্রকৃতির কি আমাদের নিয়ে ভবিষ্যত কোন পরিকল্পনা আছে?
কুরআন এবং বিবর্তন
জীবনের উৎপত্তি বিজ্ঞানের বদৌলতে আমরা জানতে পেরেছি পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব হয়েছে পানি থেকে। মহাশূণ্যে অন্য গ্যালাক্সিতে প্রাণের অস্তিত্বের সম্ভাবনা যাচাই করতে গেলেও প্রথম যে বিষয়টি আমাদের মনে আসে তা হলো সেখানে পানির অস্তিত্ব আছে কি? কেননা পানি ছাড়া প্রাণের অস্তিত্ব অসম্ভব। কুরআন আমাদের কে ১৪০০ বছর আগেই এই বাস্তবতা সম্পর্কে অবহিত করেছে। সুরা আম্বিয়া আয়াত ৩০ (নিজেদের অজ্ঞতা কারণে কিছু লোক প্রাকৃতিক অনেক পপ্রঞ্চকে দেব-দেবী হিসেবে পূজা করেছে। যদিও গোটা মহাবিশ্ব আল্লাহ তা'লা সৃষ্টি করেছেন এবং তার দেয়া নিদের্শ অনুযায়ীই সবকিছু পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমানে মহাবিশ্বের বিভিন্ন উপাদান আলাদা আলাদাভাবে বিরাজমান) কিন্তু একটা সময় ছিল যখন সবকিছু একসাথে জুড়ে ছিল। তারপর আমরা তাদেরকে আলাদা করেছি, ফলে বিভিন্ন মহাজাগতিক বস্তু নিজেদের কক্ষপথে আবর্তিত হতে শুরু করে। (২১:৩৩, ৩৬:৪০)। উদাহরণ স্বরূপ পৃথিবীর কথাই ধরা যাক। পৃথিবী তার সূচনাতে আদি বস্তুপূঞ্জ হতে আলাদা হয়। এটা যেন পাথর নিক্ষেপন যন্ত্র থেকে একটা পাথর ছিটকে বের হওয়ার মতোই -৭৯:৩০)। (অতঃপর পৃথিবী প্রাণ ধারণক্ষম হওয়ার পরপরই) আমরা পৃথিবীতে পানি থেকে প্রাণের সূচনা করি। ( সকল প্রাণীই পানি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে -২৪:৪৫। আর প্রাণের এই ফল্গুধারার ওপর আল্লাহ তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত রেখেছেন -১১:৭)। এটা খুবই আশ্চর্যজনক যে এত সব ব্যখ্যার পরও এটা মানুষ বোঝে না যে কেবলমাত্র আল্লাহ তা'লারই মহাবিশ্বের ওপর একক কর্তৃত্ব রয়েছে। প্রথম প্রাণ ছিল শৈবাল জাতীয় উদ্ভিদ। এরপর পশুকূলের উদ্ভব হয়। উদ্ভিদকুলসম্পকের্ কুরআন বলেঃ সুরা তাহা, আয়াত ৫৩: তিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীকে শয্যা করেছেন এবং তাতে চলার পথ করেছেন। আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেছেন এবং তা দ্বারা আমি বিভিন্ন প্রকার উদ্ভিদ উৎপন্ন করেছি।এই আয়াতে উদ্ভিদ জগতে যৌন প্রজননের কথাও বলা হয়েছে। বিজ্ঞান যা সমপ্রতি জানতে পেরেছে। সুরা রাদ আয়াত ৩ এ বলা হয়েছেঃ তিনিই ভূ-মণ্ডলকে বিস্তৃত করেছেন। তাতে পাহাড়-পর্বত এবং নদ-নদী স্থাপন করেছেন এবং প্রত্যেক ফলের মধ্যে দু’দু প্রকার সৃষ্টি করে রেখেছেন। তিনি দিনকে রাত্রি করেন। এতে চিন্তাশীলদের জন্য নিদর্শন আছে।
একই ভাবে প্রাণীকুলের পানি থেকে উদ্ভব হওয়া সম্পর্কে বলা হয়েছে সূরা নূর আয়াত ৪৫ঃ আল্লাহ প্রত্যেক চলন্ত জীবকে পানি থেকে তৈরী করেছেন। তাদের কতক বুকে ভর দিয়ে চলে এবং কতক চার পায়ে ভর দিয়ে চলে। আল্লাহ যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। নিশ্চয়ই তিনি সবকিছু করতে সক্ষম।

মানুষের সৃষ্টি আমরা উপরের আয়াতে দেখলাম প্রত্যেকটি প্রাণীই পানি থেকে উদ্ভব হয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী মানব দেহের ৬০ ভাগই পানি। কুরআনে বহু আয়াতে মানুষের দুনিয়াবী উদ্ভব সম্পর্কে বলা হয়েছে। বিজ্ঞান যা জানতে পেরেছে অনেক পরে। আমরা এ সংক্রান্ত আয়াতগুলো লক্ষ্য করিঃ সুরা হুদ আয়াত ৬১ তিনিই জমিন হতে তোমাদের পয়দা করেছেন এবং তন্মধ্যে তোমাদের বসতি স্থাপন করেছেন।
আমি তোমাদেরকে মৃত্তিকা থেকে সৃষ্টি করেছি। সুরা হজ্জ আয়াত ৫
তিনি তার প্রত্যেকটি সৃষ্টিকে সুন্দর করেছেন এ কাদামাটি থেকে মানুষ সৃষ্টি করেছেন। সুরা আস সাজদাহ ৭
তাদেরকে প্রশ্ন করুন, তাদেরকে সৃষ্টি রা কঠিন না আমি অন্য যা সৃষ্টি করেছি। আমি তাদেরকে সৃষ্টি করেছি এটেল মাটি থেকে। সুরা আস সাফ্ফৃত ১১ তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন পোড়া মাটির ন্যয় শুষ্ক মৃত্তিকা থেকে। আর রাহমান-১৪।
আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি মাটির নির্যাস থেকে। সুরা সাফ্ফাত আয়াত ১১ মানুষের শরীরের সকল রাসায়নিক উপাদানই মাটিতে পাওয়া যায়। এই আয়াতে মাটির নির্যাস বলতে আসলে তাই বোঝানো হয়েছে। মানুষের বিবর্তন আমরা ওপরে আলোচনা করেছি পৃথিবীতে মানুষের চারটি পর্যায়ত্রমিক দল বাস করেছে। বিজ্ঞান আমাদেরতে সে সম্পর্কে জানিয়েছে। কুরআনে কি সে সম্পর্কে কোন কথা আছে। নিচের আয়াতগুলো এব্যপারে আমাদের কিছুটা ধারণা দেবেঃ আর আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এরপর আকার অবয়ব তৈরী করেছি। অতঃপর আমি ফেরেসতাদেরকে বলেছি, আদমকে সেজদা করো। তখন সবাই সেজদা করেছে, কিন্তু ইবলিশ, সে সেজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলনা। সুরা আরাফ আয়াত ১১। যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তোমাকে সুবিন্যস্ত করেছেন এবং সুষম করেছেন। যিনি তোমাদেরকে ইচ্ছামতো আকৃতিতে গঠন করেছেন। সুরা ইনফিতার ৭-৮। আমি মানুষকে সুন্দরতর অবয়বে সৃষ্টি করেছি। সুরা আত তীন ৪। এখানে আরবী তাকভীম শব্দের অর্থ কোন কিছুকে পরিকল্পিত উপায়ে সন্নিবেশিত করা। যার অর্থ এর মধ্যে এক ধরণের ধারাবাহিকতা এবং পর্যায়ক্রমিকতা রয়েছে। অথচ তিনি তোমাদেরকে বিভিন্ন রকমে সৃষ্টি করেছেন। সুরা নূহ ১৪। সুরা আদদাহর আয়াত ২৮ এ আল্লাহ মানুষকে একটা দল হিসেবে উল্লেখ করেছেন, এবং উল্লেখ করেছেন কিভাবে তিনি একদলকে আরেক দল দ্বারা প্রতিস্থাপিত করেছেন। আমি তাদেরকে সৃষ্টি করেছি এবং মযবুত করেছি তাদের গঠন। আমি যখন ইচ্ছা করবো তখন তাদের পরিবর্তে অনুরূপ লোক আনবো।একই বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে সুরা আল আনআমের ১৩৩ নম্বর আয়াতেঃ আপনার প্রতিপালক অমুখাপেক্ষী কেউ এবং করুণাময়। তিনি ইচ্ছা করলে তোমাদের সবাইকে উচ্ছেদ করে দেবেন। এবং তোমাদের পর যাকে ইচ্ছা তোমাদের স্থলাভিষিক্ত করবেন। যেমন তোমাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে অন্য এক সম্প্রদায়ের বংশধর থেকে। কিন্তু কেউ কি এটা কখনো ভেবে দেখেছে কেন কুরআনে প্রাণের উদ্ভব সম্পর্কে সাধারণভাবে এত আয়াত, বিশেষ করে মানুষের উৎপত্তি সম্পর্কে? অথচ এটা কোন বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ নয়। এর কারণ হলো কুরআন তার অবতীর্ণ হওয়ার সময়কালের প্রচলিত ভূল ধারণাকে বাতিল করে, সঠিক মতামত তুলে ধরেছে। বাইবেলেও প্রাণএবং মানুষের উৎপত্তির বর্ণনা রয়েছে। বাইবেলের এই বর্ণনা কেবল বিজ্ঞানই নয়, এমন কি ১৯৬০ সালে অনুষ্ঠিত ভ্যাটিকানের দ্বিতীয় কাউন্সিলও প্রত্যাখান করেছে এই বলে যে, 'বাইবেলে এমন অনেক বিষয় আছে যা কিনা আধুনিক বিজ্ঞান ভূল প্রমাণিত করেছে।' বিজ্ঞানের সাথে কুরআনের এখানে কোন দ্বন্দ্ব নেই। কারণ কুরআন পুরোপুরিই আল্লাহর বাণী। আধুনিক বিজ্ঞানের অনেক আবিস্কারই এমন, কুরআন যা ১৪০০ বছর আগেই উল্লেখ করেছে। আল্লাহ তা'লা কখনো মানুষকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করার কথা বলেন নি। বরং সব সময়ই চিন্তা আর বিবেককে ব্যবহার করতে বলেছেন।
অধিকাংশ লোকই বিজ্ঞানীদের বলা সকল কথাকেই এক বাক্যে সত্য বলে ধরে নেয়। এটা তাদের কাছে কখনোই মনে হয়না যে বিজ্ঞানীদেরও নানা দার্শনিক এবং আদর্শিক দায়বদ্ধতা থাকতে পারে। আসল কথা হলো বিজ্ঞানীরা তাদের আপন অহমিকা এবং দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি বিজ্ঞানের ছদ্মাবরণে সাধারণ মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তারা এটা ভালোভাবেই জানে যে দৈব চয়নের মাধ্যেম কখনো বিশৃংখলা এবং দ্বৈধতা ছাড়া আর কিছুই তৈরী হয়না। কিন্তু তার পরেও তারা দাবী করে যে, চমৎকার সুশৃংখল, পরিকল্পিত ও অঙ্কিত এই মহাবিশ্ব ও প্রাণিসকল দৈবক্রমেই উদ্ভব হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যাক, এরকম একজন জীববিজ্ঞানী খুব ভালো করেই জানে যে, একটি প্রোটিন অণুর (জীবনের গাঠনিক উপাদান) মধ্যে বোধের অতীত এক সমতা আছে এবং তার হঠাৎ উদ্ভব হওয়ার কোন সুযোগই নেই। এতদসতেও্ব সে দাবী করে যে এই প্রোটিন বিলিয়ন, বিলিয়ন বছর আগে আদিম পৃথিবীর বাতাবরণে উদ্ভব হয়েছিলো। সে এখানেই থেমে থাকেনা। আরেকটু আগ বাড়িয়ে কোন রকম ইতস্ততা ছাড়াই এও দাবী করে য, কেবলমাত্র একটাই নয়, বরং লক্ষ লক্ষ এরকম প্রোটিন তৈরী হয়েছিল এবং অযাচিত শক্তিবলে একত্রিত হয়ে প্রথম জীবকোষের উদ্ভবহয়েছিল। উপরন্তু সে তার এই দাবী একগুয়েমিতার সাথে সমর্থন করে। আর এই লোকটি হলো একজন বিবর্তনবাদী বিজ্ঞানী। যদি এই একই বিজ্ঞানী পথ চলতে চলতে তিনটি ইটকে একটার ওপর আরেকটাকে স্তরে সজ্জিত দেখে, এটা তার কখনোই মনে হবেনা ওই ইটগুলো হঠাৎই সেখানে একত্রিত হয়েছে এবং দৈবক্রমেই একটার ওপর আরেকটা চড়ে বসেছে। বস্তুতঃ যে কেউ এধরেণর কথা বলবে পাগল ছাড়া লোকে তাকে আর কিছুই বলবেনা। তাহলে এটা কিভাবে সম্ভব, যে লোক সাধারণ ব্যাপার যুক্তি দিয়ে বিচার করতে পারে, সে একই ব্যক্তি আপন অস্তিত্ব সম্পর্কে কেমন করে অবাস্তব ধারণা পোষণ করে? এটা দাবী করা কিছুতেই সম্ভব নয় যে, এহেন দৃষ্টিভঙ্গি বিজ্ঞানের খাতিরে নেয়া হয়েছে। বিজ্ঞানকে সম সম্ভাবনার দুটো প্রস্তাবনাকেই সমান বিবেচনা নিয়ে দেখতে হয়। আর যদি ব্যাপার এমন হয় এদের একটির সত্য হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম, এত কম যে বলা যায় প্রায় শূণ্যের কাছাকাছি, তবে যুক্তিবোধের স্বাভাবিক দাবী হলো দ্বিতীয় সম্ভাবনাটিকে বাস্তব বলে ধরে নেয়া-যার সম্ভাবনা নিরানব্বই ভাগ। বিজ্ঞানের এই নীতিকে মনে রেখে আমরা সামনে এগুতে থাকি। পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশ নিয়ে দুটো ধারণা প্রচলিত আছে। এর প্রথমটি হলো সকল প্রাণই আল্লাহ তাদের বর্তমান জটিল অঙ্গসংস্থানসহ সৃষ্টি করেছেন। আর দ্বিতীয়টি হলো জীবনের উদ্ভব হয়েছে অচেতন এক দৈব কাকতালীয়তায়। আমরা যখন বিজ্ঞানের দেয়া তথ্যসমূহ দেখি- উদাহরণস্বরূপ অণুজীববিজ্ঞানের মতে, বিবর্তনবাদীদের দাবী অনুযায়ী দৈবক্রমে প্রাণ বা প্রাণকোষের উপাদান লক্ষ লক্ষ প্রোটিন অণূর কোন একটিরও উদ্ভব হওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং প্রাণের বিকাশ সম্পর্কেবিবতর্নবাদীদের ধারণা সত্য হওয়ার সম্ভাবনা শুন্য। তার মানে হলো প্রথম মতটির সঠিক হবার সম্ভাবনা পুরো একশ ভাগ। আর তা হলো সচেতনভাবে প্রাণকে অস্তিত্বে আনা হয়েছে। অন্যভাবে বলা যায় জীবনের সৃষ্টি করা হয়েছে। সকল প্রাণীই এক মহা পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময় স্রষ্টার সুপরিকল্পিত সৃষ্টি । এটা কেবলমাত্র একটা সাধারণ দাবী নয়। বরং জ্ঞান, প্রজ্ঞা এবং যুক্তিবোধের স্বাভাবিক উপসংহার। পরিশেষে আমরা বলবো, প্রকৃতিতে বিবর্তন ঘটে এবং সে বিবর্তন আল্লাহ তালাই ঘটান তার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। আধুনিক বিজ্ঞানীদের মধ্যে এই ধারণাটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। আমেরিকান বিজ্ঞানী Dr. Michael J Behe ঐ সমস্ত বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদের অন্যতম যারা প্রাণের বিকাশের ক্ষেত্রে 'বুদ্ধিমান পরিকল্পন'-এর সমর্থন করেন। তিনি ঐ সব বিজ্ঞানী যারা এই 'বুদ্ধিমান পরিকল্পন'- তত্ত্বের বিরোধিতা করছেন, তাদের বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, " গত চার দশক ধরে আধুনিক প্রাণরসায়ন কোষের রহস্য অনেকটাই উন্মোচন করেছে। এর জন্য হাজার হাজার মানুষের তাদের জীবনের সবচেয়ে সোনালী অধ্যায় গবেষণাগারের চার দেয়ালেরর মাঝে কাটাতে হয়েছে। কোষকে জানার এবং জীবনকে অণুজীব পর্যায়ে অধ্যয়ন করার এই সমবেত প্রচেষ্টার ফলাফল হচ্ছে এক সরোষ, পরিষ্কার এবং গগনবিদারী চিৎকার 'পরিকল্পন।' ফলাফল এতটাই স্পষ্ট এবং তাৎপর্যময় যে এটাকে বিজ্ঞানের ইতিহাসে অন্যতম এক আবিস্কার হিসাবে বিবেচনা করা উচিত। তার পরিবর্তে এক অদ্ভুত এবং বিব্রতকর নৈশব্দ কোষের জটিলতাকে ঘিরে আছে। কেন বিজ্ঞানমহল আকুলতার সাথে এর সবচেয়ে চমকদার আবিস্কারকে আলিঙ্গন করছেনা? কেন 'পরিকল্পন'-এর পর্যবেক্ষন নিয়ে এতো রাখঢাক?কারণ হাতির এক পীঠ 'পরিকল্পন' হলে আর পীঠ হলো সৃষ্টিকর্তা।'

ইউরো ইসলাম

উত্তর প্যারিসের পড়ো শিল্প এলাকার এক গুদাম ঘর। মধ্য অক্টোবর। আফগানিস্তানে মার্কিন বোমা হামলার কয়েকদিন পরের ঘটনা। ফরাসী মুসলমানদের মুখপত্র ম্যাগাজিন লা মেদিনা আয়োজন করেছে এক সাধারণ সমাবেশের। উদ্দেশ্য সেপ্টেম্বর ১১ এর ঘটনা এবং এর তাত্‍পর্য নিয়ে আলোচনা করা।
পরিবেশটা বেশ চমত্‍কার। পুরুষদের পড়নে কেডস আর জীনস, অধিকাংশ মেয়েদের মাথায় স্কার্ফ পড়া। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া উপস্থিতির অধিকাংশই উত্তর আফ্রিকান। প্রায় সকলেরই বয়স মধ্য বিশের কোঠায়। বক্তার আসনে আছেন ৩৯ বছর বয়স্ক সুইস বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক তারিক রামাদান। তার দাদা ১৯২৮ সালে মিশরে ইসলামী পূণর্জাগরণ আন্দোলন শুরু করেছিলেন। `এখন আমি আমার কিছু ভাইয়ের কাজকর্মের সমালোচনা করবো।` কানায় কানায় ভরা হলরুমে তিনি বললেন।` আপনারা হত্যাকে নীতি সঙ্গত করতে কুরানের দোহাই দিয়ে আসলে জুলুমের আশ্রয় নিয়েছেন।‍` ফরাসী সরকার রামাদানকে সন্দেহের চোখে দেখেন। কিন্তু আজ রাতে তার কথা বেশ যুক্তি সঙ্গতই শোনালো।
তারপর একজন তরুণী ডায়াসে উঠে এলেন। কালো হিজাব পড়া এই তরুণী মুসলিম দুনিয়ার যেকোন প্রান্ত থেকেই এসে থাকতে পারে। কিন্তু তার উচ্চারণে বিশুদ্ধ উত্তর প্যারিসীয় টান খুবই স্পষ্ট। ` মুসলমানদের জন্য আজ মানুষের কাছে তাদের ধর্মের সত্যিকার রূপ তুলে ধরার জন্য সবকিছু করতে হবে।` তিনি বললেন। পুরো হলঘর তুমুল করতালিতে মুখর হয়ে ওঠলো।
যদিও অধিকাংশ পত্রপত্রিকা ইসলামকে মিলিট্যান্ট আর আমেরিকা ও পাশ্চাত্যের বিরুধ্ধে যুদ্ধোনমত্ত হিসেবে চিত্রিত করছে, ইউরোপের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা তাদের ধর্মকে নমনীয় হিসেবেই দেখে থাকে। ব্রিটেনের বহুল প্রচারিত এশীয় সংবাদপত্র ইস্টার্ন আই-এর জন্য চালানো মোরি এজেন্সির এক জরীপে ৮৭ ভাগ মুসলমান ব্রিটেনের প্রতি নিজেদের অনুগত বলে মনে করেন। অপরদিকে ৬৪ ভাগ মুসলমান আফগানিস্তানে বোমা হামলার বিরোধিতা করেন।
এসব মানুষেরা এবং তাদের মতো আরো হাজার লোক ইসলামের এক নতুন দিক খোদাই করছেন। ইসলামের মৌলিক দিক যথা সামাজিক ন্যায়বিচার এবং আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্ম সমর্পনকে এরা ইউরোপের সমকালীন বাস্তবতার সাথে মেলাতে চায়। বেশ কিছুকাল থেকেই এ চিন্তার লালন হচ্ছে। সেপ্টেম্বর ১১ এর ঘটনা এর গতিকে করেছে তরান্বিত ।
ইউরোপের ১কোটি ৫০ লাখ মুসলমানদের অধিকাংশ মনে করেন ইউরোপে জন্ম নেয়া এবং বেড়ে ওঠা মুসলমানদের জন্য ইসলামের নতুন ব্যখ্যা প্রয়োজন। আর এ চিন্তার ফলাফল হলো ইউরো-ইসলাম- ঐতিহ্যবাহী কুরআন ভিত্তিক ধর্ম। তবে এলকোহল আর সূদভিত্তিক ঋণ গ্রহণ নিষেধাজ্ঞার সাথে পশ্চিমা গণতন্ত্র, পরমত সহিষ্ণুতা ব্যক্তি স্বাধীনতা মিশে নতুন ইসলামী মূল্যবোধ তৈরী করছে। এসব ইউরোপীয়ান তরুন দাদা-দাদীদের রেখে যাওয়া নতুন দর্শন একসময় বিশ্বকে প্রভাবিত করতে পারে।
এই নতুন প্রজন্মের জন্য ইউরো ইসলাম কোন ফঁাকা বুলি নয়। একই সঙ্গে মুসলিম এবং ইউরোপীয়ান হওয়া খুবই সম্ভব। আসল কথা হলো তাদের খ্রীস্টান প্রতিবেশীদের তুলনায় ইউরোপীয়ান মুসলিমদের বিশ্বাস দিন দিন পোখতই হচ্ছে। অক্টোবরে পরিচালিত ফরাসী সংবাদপত্র লে মন্ডের এক জরীপে দেখা যায় মুসলিমরা ১৯৯৪ সালের তুলনায় বেশী সংখ্যায় মসজিদে যাচ্ছে এবং রমজানে রোজা রাখছে। বিশ্ববিদ্যালয়গামীদের মধ্যেই এর সংখ্যা বেশী। ব্রিটেনে ১০ বছর আগের চেয়ে এখন অনেক বেশী হিজাব পড়া মহিলা চোখে পড়ে।
ইউরো ইসলাম দুই সংস্কৃতির মাঝে সেতু বন্ধন। তরুণ বিশ্বাসীদের উত্তারাধিকার সূত্রে পাওয়া মূল্যবোধের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং একই সাথে ভিন্ন এক দুনিয়ায় সহবাস করার উপযোগী করে তোলাই এর লক্ষ্য। এটা নিজেদের ধর্ম অনুসরণে, তাদের পিতা-প্রপিতামহদের চাইতে - যারা উইরোপে তাদের ভ্রমনকে সংক্ষিপ্ত সফর হিসেবে নিয়েছিলেন- অনেক খোলাখুলি ভাব এনে দিয়েছে। তাদের সন্তানরা ইউরোপকে নিজেদের ঘর বলে মনে করে এবং প্রকাশ্যে নিজের বিশ্বাস পালন না করার কোন কারণ খুঁজে পায়না।
রমজানের সময় আহমিদ, রোম ইসলামিক সেন্টারের মরোক্কান বংশোদ্ভুত একজন ইমাম কেন্দ্রীয় মসজিদের বাইরে তার স্টলে কুরআন এবং বিভন্ন মুসলিম প্রচারকারীর ক্যাসেট বিক্রি করছিলেন। ১৩ বছর আগে ইটালীতে প্রবেশ করার পর মরোক্কান এই মুসলিম অনেক বেশী ধর্মপরায়ন হয়েছেন। তিনি বলেন, `অভিবাসীরা শান্তনার জন্য ধর্মের দিকে ফেরে। মুসলমানরা সবসময়েই দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে গিয়েছে এবং মুসলমানের জীবন যাপন করতে শিখেছে। অন্যদেরকেও তাদের মতো জীবন যাপন করতে দিয়েছে।`
যেমনটি আহমিদ বলেছেন, ইউরোপে মুসলমানদের ইতিহাস হচ্ছে অভিবাসীদের ইতিহাস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মহাদেশের পুণর্গঠনে ব্রিটেন এবং ফ্রান্স উত্তর আফ্রিকা এবং দক্ষিন এশিয়ায় তাদের পুরনো কলোনীগুলোর দ্বারস্থ হয়। জার্মানী অতিথি শ্রমিকদের জন্য তাদের দুয়ার খুলে দেয়। যাদের অধিকাংশই এসেছিল তুরস্ক থেকে। যারা আর কখনো ফিরে যায়নি। এখানে তাদের ছেলে মেয়েরা জন্ম নিয়েছে এবং ইউরোপিয়ান হিসেবে বেড়ে উঠেছে। এই তিন দেশে মুসলিম কমিউনিটির সংখ্যা ইউরোপে মধ্যে সর্বাধিক। ফ্রান্সে ৫০ লক্ষ, জার্মানীতে ৩২ লক্ষ এবং ব্রিটেনে ২০ লক্ষ। এই সংখ্যা স্পেন, হল্যান্ড, ইটালি, বেলজিয়াম এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে সাম্প্রতিক অভিবাসনের কারনে পরিবর্তিত হয়েছে।
তবে ইউরোপে ইসলাম নতুন নয়। ৭৩২ সালে টুরস পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়ে আরবরা ১৪৯২ সাল পর্যন্ত স্পেনে ছিল। এসময় তারা গ্রানাডা থেকে বিতাড়িত হয়। স্প্যানিশরা তাদের j অক্ষরেরর স্বতন্ত্র উচ্চারণ আর মুরিশ পূরকৌশল আরবদের কাছ থেকেই পেয়েছে। ইসলামিক পন্ডিত ইবনে সিনা এবং আবু রুশদ পাশ্চাত্যের কাছে নতুন করে গ্রীক দর্শনকে পরিচিত করেছিলেন। আরব বিজ্ঞানীরা বীজগণিত আবিস্কার করে বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে অভুতপূর্ব ভূমিকা পালন করেছিলেন। অটোমান বাহিনী বলকান পেনিসুলার পশ্চিমে পৌছেছিলো ১৪ শতকেই। তাদের প্রতিষ্ঠিত মুসলিম কমিউনিটি এখনো মধ্য ইউরোপে বিদ্যমান।
সরায়েভোতে ইমাম পূণর্গঠিত মসজিদ থেকে নামাজের জন্য মুসল্লীদের আহবান জানান। মসজিদটা ১৯ শতকের ক্যাথিড্রাল এবং মধ্যযুগের অর্থডক্স খ্রীস্টান গির্জার ডিজাইনে তৈরী। "দূর পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের মুসলমানদের চাইতে প্রতিবেশী খ্রীস্টান সার্বদের সাথে আমার অনেক মিল।" বললেন বসনিয়ার সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মুহাম্মদ বেসিচ। তার কথা প্রমাণ করে এই মহাদেশে ইসলামের শেকড় কতটা গভীর। মাত্র ১০ বছর আগেই শহরটি বসনিয়ার সার্বদের দ্বারা ঘেরাও হয়েছিল। কিন্তু তারা একই সাথে নিজেদের মিলমিশের কথাও বলে, যুদ্ধ যা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারেনি।
ছবির ভিন্ন দিকটা হলো ১৪০০ বছরের মধ্যে মুসলমানরা এই প্রথমবারের মতো একটা ধর্মনিরপেক্ষ সমাজে সংখ্যালঘু হিসেবে বাস করছে। প্রথাগত ইসলামী ধর্মতত্ত্ব দুনিয়াকে দুভাগে ভাগ করে। একভাগে আছে দারুল ইসলাম আর অন্যভাগে দারুল হারব। এই বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে মনে করা হয় মুসলমানরা অমুসলিম দেশে কখনো পৃরোপুরি ইসলামের অনুসরণ করতে পারবেনা। কাজেই তারা সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করবেনা। কিন্তু দ্বিতীয় এবং তৃতীয় প্রজন্মের ইউরোপীয়ান মুসলমানরা বুঝতে পেরেছেন সেটা সঠিক নয়। সুতরাং নতুন মত যেমন দারুসশুহাদার কথা কেউকেউ বলছেন। এটা একটা নতুন ধারণা, যে মতে মুসলমানরা অমুসলিম দেশে নিজেদের ধর্ম এবং বিশ্বাস অনুযায়ী জীবন যাপন করতে পারবে।
তারিক রামাদান এই নতুন চিন্তার একজন অন্যতম পুরোধা। তিনি বলেন," একজন মুসলিম হিসেবে আমি দুনিয়ার যে কোন প্রান্তেই সাচ্ছন্দ্য বোধ করতে পারি, যদি আমার চিন্তা আর মতের স্বাধীনতা এবং স্বাধীনভাবে আমার ধর্ম পালন করার সুযোগ থাকে।" তিনি আরো বলেন, "এই নতুন পরিবেশ আমার নিজের বিশ্বাসের প্রতিনিধত্ব করার গুরু দায়িত্ব রয়েছে।‌"
ইউরোপীয়ান মুসলমানরা দুনিয়ার অন্যপ্রান্তের মুসলমানদের সাথে তাদের বিশ্বাসের ক্ষেত্রে কোন ভিন্নতা পোষন করেনা। তবে ইসলামিক ফাউন্ডেশন লেস্টারেরর গবেষক দিলওয়ার হোসেনের মতে, "তাদের অবশ্যই বৃহত্‍ সংবেদনশীলতা, সুপরিসর সমাজ সম্পর্কে সচেতনতা এবং অধিক উদার দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে।"
হোসেন বলেন, ইউরোপের উদার দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্বাসীদের তাদের বিশ্বাসকে নতুনভাবে বিবেচনা করতে বাধ্য করছে। " তরুণ মুসলিমরা মূলের দিকে ফিরে যাচ্ছে এবং নিজেরাই নিজেদের প্রশ্ন করছেঃ আমার বাবা-মা কেন এরূপ করতেন, এটা কি সত্যিই আমার বিশ্বাসের অঙ্গ, নাকি এটা তাদের সংস্কৃতির অংশ?" বিশ্বাস এবং সংস্কৃতির মধ্যে এই পার্থক্য টানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। "আপনি ইসলামিক বিধানে কিছু পেয়ে থাকতে পারেন, কিন্তু আপনার সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল তাকে ভিন্নভাবে ব্যখ্যা করতে পারে। যখন সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল পরিবতির্ত হয় তখন ওই একই বিধান ভিন্ন ব্যাখ্যা পেতে পারে।" বললেন, লাজ সামী ব্রিজ, ফরাসী ইসলামিক ইউনিয়নের সভাপতি। "আমরা আমাদের নিজস্ব ধারায় ইসলামকে মানার চেষ্টা করছি আর এটা মরক্কোর, আলজেরিয়া কিংবা সৌদি আরব থেকে ভিন্নই হবে।"
বেলজিয়ামে বসবাসকারী ৩৬ বছর বয়স্ক মরোক্কান ইমাম ইয়াকুব মাহী`র জন্য নতুন পরিবেশে ইসলামকে সমন্বিত করাই প্রধান কাজ। তিনি বলেন, "অনেক দেশ শরীয়াকে মনে করে একটা শাস্তির বিধান-যদিও কেবলমাত্র কুরআনের ১ ভাগে এ সম্পর্কে কথা বলা হয়েছে। ইউরোপে আমরা শরিয়াকে আইন হিসেবে নয়, বরং একটা পন্থা হিসাবে দেখে থাকি যাকে এর অন্তর্নিহিত মর্মে আমাদের বুঝতে হবে। আমরা যখন ইউরোপের প্রত্যাহিক জীবনের সাথে মেলাই তখন আমরা দেখি, শরীয়া বলতে কেবল চোরের হাত কাটাই বোঝায়না। বরং এটা একটা স্পিরিট যা আমরা ইউরোপের অনেক কিছুতেই অবলোকন করি: গণতান্ত্রিক নীতি, আইনের শাসন, চিন্তা এবং সংগঠনের স্বাধীনতা প্রভৃতি।" এই চিন্তামূলক ব্যখ্যা মুসলিম আইনকে পশ্চিমা আইনের সমোপযোগী করে। সুতরাং মাহী একটা "আধ্যাতিক নাগরিকত্বের নীতি'র কথা বলেন, যেখানে মুসলমানরা আইনকে [ধর্ম নিরপেক্ষ সমাজের] মেনে চলেন, কিন্তু তাদের সকল কাজকর্মে একটা আধ্যাত্মিক আমেজ দেয়ার চেষ্টা করেন।
ইউরোপে মুসলমানদের বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা নিয়েও ভাবতে হয়। যেমন ইউথানাসিয়া বা অনুরোধে হত্যাকরা, গর্ভপাত এবং যৌনতা। এসব অনেক ইসলামিক দেশেই নিষিদ্ধ কর্ম। তবে কোথাও এই সমস্যা নারী অধিকারের সমস্যার মতো এতটা প্রকট নয়। নবী মুহাম্মদের(সঃ) দেয়া সপ্তম শতকের বিধান তাদের অবস্থা অনেক উন্নত করেছে। যেমন মেয়ে শিশু হত্যা বন্ধ এবং নারী শিক্ষাকে একটা পবিত্র দ্বায়িত্ব হিসাবে ঘোষণা করা। ধর্ম নয় বরং সংস্কৃতি এবং পুরুষরাই মহিলাদেরকে পেছনে ফেলে রাখতে চায়। বললেন, লন্ডন কেন্দ্রীয় মসজিদের আন্তবিশ্বাস সম্পর্ক এবং শিক্ষা বিষয়ক দফতর প্রধান ফাতমা আমের। " নিজেদেরকে সংগঠিত করা এবং সমাজ যা করতে বলে তার সবটাই নিঃসংকোচে না করার মানসিকতা মুসলিম নারীদেরকে গড়ে তুলতে হবে।"
আরেকটা দিক, যার সম্মুখীন পুরুষ এবং মহিলা উভয়েই, তা হলো বিয়ে। ব্রিটেনে উল্লেখযোগ্য মুসলিম তরুণী বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান থেকে তাদের চাচাতো-মামাতো ভাইবোনদে সাথে ঠিক করা বিয়েতে মত দিতে অস্বীকার করছে। ফ্রান্সেও তরুণীরা তাদের বাবা-মার মতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছে যারা আশা করেন, মেয়েদেরকে মরক্কো অথবা আলজেরিয়ায় নিজেদের গ্রামের কারো সাথে মেয়েদের বিয়ে দেবেন। "আমরা নিজেদের পাত্র নিজেরাই পছন্দ করতে চাই। বললেন ফওয়াজ ইমেরিন।" প্যারিসের শহরতলী সেন্ট ডেনিসের তাওহীদ কালচারাল সেন্টারের পরিচালিক তিনি। "যদি তারা আমাদের বিশ্বাসের কেউ হয়, তবে গায়ের রং এ কিছু যায় আসেনা।"
ইমেরিন বললেন ইউরোপীয়ান মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গির কেমন পরিবর্তন হয়েছে। "আমরা যখন ছুটি কাটাতে উত্তর আফ্রিকায় যাই তখনই বুঝতে পারি ফ্রান্সের সাথে আমাদের বন্ধন কতটা গভীর।"‌ কনক্রীট টাওয়ার ব্লকের নীচের কফি দোকানে বসে নিজের কফিতে চুমুক দিতে দিতে তিনি বললেন। "আমার প্রজন্মের খুব কম সংখ্যকই বিশ্বিবদ্যালয়ে যেতে পেরেছে। ইসলাম আমাদের স্কুলে বিফলতা থেকে এবং সমাজ থেকে বিছ্ছিন্ন হওয়া থেকে আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু এখনকার তরুনরা ইসলামকে সার্বজনীন মূল্যবোধের ভিত্তি বানাতে কাজ করছে। নিজেদেরকে মুসলিম হিসেবে পরিচয় দিয়েই অন্যদের সাথে আদান প্রদানের সম্পর্ক গড়ে তুলছে।"
এই প্রজন্মের ইউরোপকে নিজেদের ঘর হিসেবে নেয়ার পরিপূর্ণ মানসিকতা আছে। এমনকি যদিও এটি প্রায়শই অনাতিথিপরায়নতার পরিচয় দিয়েছে। ফ্রান্সে হিজাব পড়ার অপরাধে স্কুলের মেয়েরা বহিস্কারের স্বীকার হয়েছে। এমনকি ব্রিটিস মুসলিম কমিউনিটিতে বেকারত্বের সংখ্যা অন্য কমিউনিটি থেকে দ্বিগুন। কিন্তু এই নব্য প্রজন্মের জন্য মুসলিম এবং ইউরোপীয়ান হওয়া সমাজিক বাধ্যবাধকতার চাইতে ব্যক্তিগত পছন্দই প্রাধান্য পেয়েছে।
তরুণ মুসলমানেরা কুরআনের ব্যখ্যায় খুবই ব্যক্তিস্বাতন্ত্রিক। কিন্তু তার মানে এ নয় যে তারা কম ধার্মিক। বললেন ৩৬ বছর বয়সী সাংবাদিক মুসতাফা আওবিখ। তিনি হেগে কাজ এবং বাস করেন। উদাহরণস্বরূপ ডাচ ওয়েব সাইট Maghreb.nl চ্যাট রুমে আলোচনার বিষয় করেছে মুসলিম নববিবাহিতদের জন্য মুখমেহন জায়েজ কিনা। আওবিখ বলেন, "তারা নিজেদের জীবন কিভাবে চালাবে তা নিজেরাই ঠিক করতে চায়।" ব্যক্তিগত পছন্দের এই দৃষ্টিভঙ্গি অনেক মুসলমানকে নতুন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিও দিয়েছে।
কঠোর ধর্মীয় সমস্যা কমে আসেছে। ফরাসী লা মেদিনা পত্রিকার সম্পাদক হাকিম আল ঘাসিসী বললেন। তরুণরা মুসলমানদের সামজিক সমস্যা যেমনঃ বেকারত্ব, শ্রম বাজারে সমতা রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব এবং বিদ্যালয়ে যেভাবে ইতিহাস পড়ানো হয় ইত্যকার সমস্যা নিয়ে অনেক সোচ্চার। এসব বিষয়ে মুসলমানরা নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরতে বদ্ধপরিকর। তারা স্থানীয়, জাতীয় এবং ইউরোপীয়ান পর্যায়ে সরকারে অংশ গ্রহণ করতে চায়।
এখন পর্যন্ত মুসলমানদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব বেশ কম। ৮ লাখ মুসলিম জনসংখ্যার দেশ নেদারল্যান্ডে ৭ জন মুসলিম এম,পি আছে। ব্রিটেনে এ সংখ্যা মাত্র ২ জন আর ফ্রান্সে ১ জন। তা সত্বেও গটিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ের শিক্ষক বাসসাম তিবি, জিনি ইউরো ইসলামের অন্যতম প্রস্তাবকারী, বলেন ইউরোপে মুসলমানদের আত্মীকরণ নির্ভর করে ইসলামের এমন এক রূপ গ্রহণ করা যা, বহুত্ববাদীতা, সহনশীলতা, ধর্ম এবং রাষ্ট্রের বিচ্ছিন্ন করণ, গণতান্ত্রিক সূশীল সমাজ এবং ব্যক্তিতান্ত্রিক মানবাধীকার ইত্যকার পশ্চিমা মূল্যবোধের সাথে সংগতিশীল হবে। ই্উরো ইসলাম অথবা মুসলিম সঙখ্যালঘুদের নির্দিষ্ট এলাকায় আবদ্ধ করে রাখার মধ্যবর্তী কোন বিকল্প নেই।
ব্রিটেনে এমতের সমর্থন পাওয়া যায় লেখক, সমালোচক জিয়াউদ্দীন সর্দারের কথায়। ১৯৬০ সালে তিনি বাবা-মার সাথে ব্রিটেনে আসেন। "যদি সমাজিক পরিবর্তন আনতে হয়, তবে ধর্মতাত্ত্বিক পরিবর্তনের কথাও ভাবতে হবে।" তিনি বললেন। "ইসলামে আইন এবং নৈতিকতা একই জিনিষ। যদি আপনি নৈতিকতা পরিবর্তন করেন, তবে আইনও পরিবর্তিত হয়। আর তা হবে ইসলামের নতুন এক ব্যখ্যা।"
এই নতুন ব্যখ্যা বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন গতিতে প্রসারিত হচ্ছে। যদিও অমুসলিমরা ইসলামকে একটা এককেন্দ্রিক মত হিসেবে দেখে থাকে, কিন্তু ইসলাম মূলতঃ বৈচিত্রের সমন্বয়ক। সারা দুনিয়ার বিভিন্নপ্রান্তে ১ বিলিয়নেরও বেশী অনুসারী নিয়ে ইসলাম, শিয়া এবং সুন্নী বিভাগসহ জনতান্ত্রিক বিভিন্নতায় নয় বরং এর উম্মাহ ধারণায় একটা একক বৃহত্‍ আদর্শিক সমাজ। এটা ইউরোপের ক্ষেত্রেও সত্য। "মুসলমানরা এখানে যে সমস্যার মোকাবেলা করছে তা হলো যেসব দেশে তারা বাস করে সেসব দেশের প্রাতিষ্ঠানিকতা দিয়ে প্রভাবিত।" বললেন, প্যারিস স্কুল অব পোস্ট গ্রাজুয়েট স্টাডিজ ইন সোশাল সাইন্স এর অধ্যাপক ফরহাদ খসরুআখবার। তবে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রভাব এবং অন্য ধর্মের প্রতি সহনশীলতার মনোভাব তাদেরকে এক বিন্দুতে আনার চেষ্টা করছে।
আর এই প্রভাব মুসলিম বিশ্বের অন্য অংশেও প্রসারিত হচ্ছে। ইমাম এন্ড মস্ক কাউন্সিল অব ব্রিটেনের চেয়ারম্যান, জাকী বাদাবীর মতে পাশ্চাত্যের মুসলমানরা ঐসব প্রশ্নের জবাব দেয়ার চেষ্টা করছে, যেগুলো কয়েক শতাব্দী ধরে মুসলমানদের তাড়িয়ে ফিরছে, আর তা হলোঃ আধুনিকতা এবং ঐতিহ্যের মাঝে কিভাবে সমন্বয় করা যায়। "অন্য অনেক সমাজব্যাবস্হার মতোই ইসলামও আধুনিকতাকে একটা চ্যালঞ্জ হিসাবেই দেখে।" বাদাবী বললেন। "যদিও ওসব সমস্যা মূলতঃ উন্নয়নশীল দেশসমূহেই বেশী এবং সেসব দেশের বুদ্ধিজীবীদের এর বিশ্লেষণ করে কার্যকর সমাধান বের করার মতো স্বাধীনতা নেই। ইসলাম এবং আধুনিকতার মধ্যকার টানাপোড়েনের সমাধান পাশ্চাত্যের চিন্তাশীলদের মাধ্যমেই হবে এবং আমাদের মাতৃভূমিতে তাকে হস্তান্তর করতে হবে।" বাদাবী মত দিলেন।
এটা হবে প্রতিকীগতভাবে এবং ঐতিহাসিকভাবে সমসাত্বিক যদি ইসলামের পরবর্তী সংস্কার পাশ্চাত্যে বসবাসকারী মুসলমানদের কাছ থেকে আসে। কারণ মুসলিম ক্যালন্ডরের সূচনা মুহাম্মদের(সঃ) জন্ম সাল থেকে হয়নি, বরং এর শুরু হয়েছে মদিনা থেকে যেখানে প্রথম মুসলিম কমিউনিটি গড়ে উঠেছিল। "মুসলমানদের প্রথম ভিত্তি গড়ে উঠেছিল হিজরতের মাধ্যমে।" বললেন লেখক সরদার। এখানেই হিজরতের গুরুত্ব, আর তা হলো ভবিষ্যতের জন্য একটা প্রকৃত ‌নমনীয় ঐতিহ্য গড়ে তোলা। ইউরোপে হিজরতকারী মুসলমানদের হাতে ইতোমধ্যেই এই দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি

রাজনৈতিক সংস্কৃতি যে কোন জাতির মানসিক পরিপক্কতার পরিমাপ সূচক। সমাজ বিজ্ঞানীরা কোন জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস, দৃষ্টিভঙ্গি আর আচার আচরণ কিভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে কিভাবে প্রভাবিত করে এবং তার ওপর ভিত্তি করে ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীর ভূমিকা কিভাবে নির্ধারিত হয় সেটা বোঝাতে পরিভাষাটি ব্যবহার করেন। কাজেই একটা দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা পরিবর্তনে উদ্যোগী হতে হলে সে দেশের জনগণের রাজনৈতিক সংস্কৃতি জানা অত্যান্ত জরুরী। Almond এবং Verba রাজনৈতিক সংস্কৃতির বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, "The specifically political orientations--attitudes towards the political system and its various parts, and attitudes toward the role of the self in the system.‍” বিদ্যমান নিবন্ধে একাডেমিক আলোচনার অবতারণা করা আমাদের লক্ষ্য নয়। আজকের তরুণ প্রজন্ম যাতে আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থার সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে বাংলাদেশকে একবিংশ শতকের উপযোগী রাজনৈতিক ব্যবস্থার দিকে নিয়ে যেতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রেখেই এই আলোচনা। এই অনুসিদ্ধকে সামনে রেখেই আমরা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির স্বরূপ খোজায় মনোযোগী হবো।
ভৌগলিক অবস্থান
একটা দেশের ভুগোল কি সে দেশের বসবাসরত মানুষের চরিত্রে কোন প্রভাব ফেলে? সমাজ বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে একমত। রুক্ষ এলাকার অধিবাসীদের মেজাজ মর্জি অনেকটা রুক্ষ আর অমার্র্জিতই হয়। উষ্ঞ এলাকার লোকেরা কিছুটা আরাম প্রিয়, আবার পাহাড়ী এলাকার লোকেরা সহজাত কারনেই বেশ কষ্ট সহিষ্ঞু। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া পুরো বাংলাদেশ বৈচিত্রহীন এক সমতল ভূমি । নরম পলিমাটি এদেশের মানুষকেও করেছে স্বভাবে নরম। অন্যদিকে আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনাও মানুষের চরিত্রে বেশ ছাপ রাখে। কোন আগাম সতর্ক বাণী ছাড়াই বাংলাদেশের প্রকৃতি হঠাত্‍ রুদ্র হয়ে ওঠে। এদেশের মানুষেরাও যেন সেরকমই। হঠাত্‍ করেই তারা বিদ্রোহী হয়ে উঠে, তখন লক্ষ্য অর্জনে সবর্স্ব পণ করতে মানুষগুলো দ্বিধা করেনা। ‌‍৭১ এর মুক্তি যুদ্ধ আর ৯০ এর এরশাদ বিরোধী অভ্যুত্থান সে কথাই আমাদের স্বরণ করিয়ে দেয়। বাংলাদেশের মানুষেরাই পাকিস্তান আন্দোলনে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল । কিন্তু নিজেদের পরিচয়ের ব্যাপারটি যখন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়, সে সাধের পাকিস্তানকে ছুড়ে ফেলতে তারা দ্বিধা করেনি।
ধর্ম
যেকোন দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে ধর্ম ব্যপকভাবে প্রভাবিত করে। সেটা পশ্চিমের উন্নত দেশগুলোর জন্যও সত্য। এবারে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি জর্জ বুশের দ্বিতীয় দফা নিবার্চনে নব্য খ্রীস্টবাদীরা বেশ ব্যপক ভূমিকা রেখেছে। ইরাক আক্রমনের আগে জর্জ বুশ ইশ্বরের নিদের্শনা পাওয়ার জন্য সারা রাত গির্জায় কাটিয়ে সকাল বেলা সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিলেন। আমেরিকার দক্ষিনের রাজ্যগুলো এখনো বাইবেল বলয় হিসেবেই পরিচিত। ধর্ম মানুষের আলাদা জাতীয় পরিচয়ও দেয়। ভারত ভাগ হয়েছিল ধর্মের ব্যবধানকে সামনে রেখেই। বাংলাদেশের শতকরা ৮৮ ভাগ লোক মুসলিম। আর এই মুসলমান হবার সুবাদে দেশের রাজনৈতিক সরকার নিবার্চনে ধর্ম বেশ ভালোই ভূমিকা নেয়। নিজেরা খুব যে ধর্মভীরু ব্যাপার সে রকম নয়। কিন্তু ধর্মকে সব সময়ই একটা বিবেচনা হিসেবে মানুষ সামনে রাখে। কাজে কাজেই নিবাচর্ন এলেই আওয়ামী লীগের মতো ধর্ম নিরপেক্ষ দলকেও মাথায় পট্টি আর হাতে তসবিহ নিয়ে জনগণকে নিজেদের ঘরে ভেরানোর প্রয়াশ নিতে দেখা যায়। বি. এন. পি নেতাদের ওমরা করার হিড়িক পড়ে যায়। কেউ “খুশি হবে আল্লায় ভোট দিলে পাল্লায়” বলে জনগণের ধর্মীয় দূবর্লতাকে নিজেদের ফেরে আনতে চায়। রাজনৈতিক দলগুলোর ধর্ম চিন্তা নয়, ধর্মের প্রতি জনগণের দূবর্লতাই এর কারণ।
আর্থ-সামাজিক অবস্থা
আর্থ-সামাজিক অবস্থা রাজনৈতিক সংস্কৃতি নির্ধারণে বেশ বড় একটা প্রভাবক। বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের একটা গরীব দেশ। চক্ষু লজ্জার কারণে উন্নয়নশীল দেশের অভিধা দেয়া হলেও, ঘরের কথা হলো আমাদের জনগোষ্ঠীর দুই তৃতীয়াংশই এখনো দারিদ্র সীমার নীচে বাস করে। ফলে গ্রামের প্রভাবশালী লোকেরাই জনগণের পক্ষে মতামতের দায়িত্ব পালন করে। ১০০ টাকার বদলে নিজের ভোটটা অসাধু লোকের কাছে বিক্রি করতে কোন মানসিক যাতনাই লোকেরা অনুভব করেনা। আখেরে পুরনো প্রবাদই সত্য “অভাবে স্বভাব নষ্ট।” আর্থ-সামজিক অবস্থার কারণেই দেশের ব্যপক জনগোষ্ঠি অশিক্ষিত। ফলে যেকোন গুরুত্বপূর্ণ স্বিদ্ধান্ত ব্যপক জনগোষ্ঠীর জন্য স্কুলের মাস্টার কিংবা শিক্ষিত মোড়লই নেয়। কাজেই জনমত গঠনকারী এই প্রতিষ্ঠানগুলো নিবার্চনে যাদের সমর্থন দেয়, ভোটের পাল্লা সেদিকেই ঝুকে।
ব্যক্তি পূজা
যে কোন জাতির পরিচয় নির্ধারণে একটা কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব থাকে। মাকির্ন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয়তাবোধ তৈরীতে জর্জ ওয়াশিংটন কেন্দ্রীয় নিয়ামক হিসেবে স্বীকৃত। রাণী ভিক্টোরিয়া ইংল্যাণ্ডের আইকন। গাণ্ধী ভারতের জন্য যে ভাবে প্রযোজ্য, জিন্নাহ’র ঠিক সে রকমই একটা ভূমিকা আছে পাকিস্তানের রাজনীতিতে। দুঃখজনক হলেও সত্য বাংলাদেশের জন্য তেমন কোন একক ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠেনি। এখানে কেউ মুজিব সৈনিক, কেউ জিয়ার, এরশাদ কোথাও হামাগের পোলা। কেউ গোলাম আযমের অনুসারী। কারো ধমনীতে মাস্টারদা’র রক্ত। প্রকৃত বাংলাদেশী যেন কেউ নয়।
পরমত অসহিষ্ঞুতা
সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিচায়ক হলো পরমত সহিষ্ঞুতা। অপরের মতের প্রতি শ্রদ্ধাভাব পশ্চিমের গণতন্ত্রের প্রধান স্তম্ভ। ‌‘ আমি আপনার মতকে পছন্দ করিনা, কিন্তু আপনার মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজনে আমি আমার প্রাণ দেবো।’ এই মূলনীতি পশ্চিমের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ আর মানসিকতাকে পরিপক্কতা দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে পরমত সহিষ্ঞুতা সূদুর পরাহত। এখানে কেউ রাম-বাম পন্থী, কেউ ভারতের দালাল। কেউবা রাজাকার, আল বদর। কেউ আমেরিকার দালাল। কেউ নাকি মস্কোয় বৃষ্টি হলে ঢাকায় ছাতা ধরতো, কেউ একই কাজ করে দিল্লীতে বৃষ্টি হলে। পছন্দ না হলে ব্যক্তির চরিত্র হননে এমনকি রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরাও উত্‍সাহী ভূমিকা নেন। এই অবস্থা বাংলাদেশের মানুষকে বিভিন্ন রাজনৈতিক শিবিরে ভাগ করে রেখেছে। একক জাতীয়বোধ দেয়নি। মীমাংসা হয়নি এ প্রশ্নেরও আমরা বাঙালী না বাংলাদেশী।
চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী
রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদলে বিভিন্নচাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। বিভিন্ন শ্রমিক ইউনিয়ন, পেশাজীবি গোষ্ঠী বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ সরব। ফলে অর্থনৈতিক অঙ্গনে রাজনৈতিক আনুগত্যের বিভিন্নতা দেশের উন্নয়নের গতিকে মারাত্মকভাবে ব্যহত করে। হরতালের মতো অর্থনীতি ধ্বংসকারী হাতিয়ার চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীগুলোর অন্যতম উপায়। সরকারের ক্ষতি করার নামে জাতীয় সম্পদের যে ধ্বংস লীলা চলে সেটি যেন তারা বুঝেও বোঝেনা। ধর্মঘটের নামে দেশ থেকে বিনিয়োগ বিতাড়িত করে হতাশ যুবকদের সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়ে সন্ত্রাস আর হানাহানিকে অনেক যুবকের বাচার অবলম্বন করা হয়েছে। একই কথা খাটে শিক্ষায়তনের বিষয়েও। শিক্ষা ক্ষেত্রে আমাদের ডিগ্রী আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মূল্যহীন। আমাদের মেধার উত্তম অংশ মেধা চালানের কারণে অন্যের অর্থনীতির চাকাকে সচল করছে নিজের চাকাকে জং ধরার জন্য ফেলে রেখে। দুঃখজনক হলেও এটি আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির এখন অন্যতম দিক।

বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির আরো বিধ্বংসী দিকই তুলে ধরা যায়। কিন্তু সেটি আমাদের আসল লক্ষ্য নয়। আমরা অনুভব করি বাংলাদেশে এখন একটা ব্যপক বিপ্লবের প্রয়োজন রয়েছে। তবে সেটা সরকার বদলে আরেকটা সরকার প্রতিষ্ঠার বিপ্লব নয়। বরং এ বিপ্লব হবে আমাদের সামজিক অবস্থান পরিবর্তনের বিপ্লব । দেশের পুরো রাজনৈতিক সংস্কৃতির আমুল পরিবর্তন ঘটাতে হবে। সকলকে সবকিছু ছেড়ে দিয়ে কেবল বাংলাদেশী হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। আর এজন্য অবশ্যই জাতির তারুণ্যের গা ঝাড়া দিয়ে ওঠা দরকার। একটা দেশকে পরিবর্তনের জন্য অনেক লোকের দরকার নেই। দরকার কেবল সিদ্ধান্ত নিতে পারার মতো সাহসী একটা অংশের। দরকার কথার চেয়ে কাজ করে দেখানোর মতো লোকের। প্রয়োগ দেখার পরই তত্বের প্রয়োজন হয় তাকে ব্যখ্যা করার জন্য। নিউটন কি গতি সূত্রের আবিস্বারক, নাকি তার সন্ধান প্রাপ্ত? কিংবা কলম্বাস আমেরিকা খুজে পেয়ছিলেন নাকি সেটা আবিস্কার করেছিলেন। এসব প্রশ্নের জবাব খুজে নিলে আমরা বুঝবো আমাদের অভাব কোথায়। তাহলেই ব্যখ্যার জন্য আমাদের আর কারো দ্বারস্থ হতে হবেন। প্রয়োজন হবেনা সি্দ্ধান্ত নেয়ার জন্য অন্যের উপদেশ খয়রাত করার।